অংশগ্রহণমূলক কাজ ৫

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা - বুদ্ধের জীবনকথা | NCTB BOOK

চার নিমিত্তের চারটি দৃশ্য লেখো

 

 
 
 
 

 

 

গৃহত্যাগ

 

সেদিন ছিল আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে ধরণি আলোকিত। সে আলোয় প্রদীপ্ত হলো রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের অন্তর। জগতের এই অনিবার্য দুঃখ-ক্লেশ থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়। কীভাবে সকলের জন্য মুক্তির পথ উন্মুক্ত করা যায় এই চিন্তায় তিনি বিভোর। এমন সময় তিনি সংবাদ পেলেন তাঁর এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। উপলব্ধি করলেন, সংসারের মোহে তিনি আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। তিনি অনুভব করলেন, এ বাঁধন থেকে মুক্ত হতেই হবে। সংসারের বন্ধন ছিন্ন করার অভিলাষ পূরণের এটাই যেন উপযুক্ত সময়।

 

 

আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চারিদিক নিস্তব্ধ। প্রাসাদে সকলেই ঘুমে আচ্ছন্ন। তিনি ডাকলেন প্রিয় সারথি ছন্দককে বললেন, আমার ঘোড়া নিয়ে এসো। আমি গৃহত্যাগ করব।

আদেশ পালনকারী ছন্দক অশ্ব কম্বককে সাজিয়ে আনলেন। বিদায়ের আগে গৌতম একবার গোপাদেবীকে দেখতে গেলেন শয়নঘরে। পুত্র রাহুলকে বুকে জড়িয়ে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তাঁকে আর জাগালেন না।

বিলম্বের কারণে মনের স্থিরতা নষ্ট হতে পারে, তাই শিগগির যাত্রা করা উচিত। সংসারের মায়া-মোহের বন্ধন ত্যাগ করে যাত্রা করলেন অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। ঘোড়ায় চড়ে অনোমা নদীর তীরে পৌঁছলেন। পিছনে পড়ে রইল রাজপ্রাসাদ। সামনে অনোমা নদী। কুলকুল করে বইছে নদীর জলস্রোত। অনোমার তীরে এসে ঘোড়া থামালেন। রাজকুমার গৌতম বললেন, আর নয় ছন্দক, এখান থেকে তুমি ফিরে যাও। শুনে বুক ভেঙে যায় ছন্দকের। কিন্তু উপায় নেই। কুমারের আদেশ হলো কম্বককে নিয়ে রাজবাড়িতে ফিরে যাও।

তারপর তিনি গায়ের রাজ আভরণ খুলে ছন্দকের হাতে দিয়ে তাকে বিদায় দিলেন। গৌতমের বিয়োগব্যথা তাঁর ঘোড়া কম্বককে বিষাদে আক্রান্ত করল। প্রভুর বিদায়-দুঃখ সইতে না পেরে সেখানে প্রাণত্যাগ করল কম্বুক। বেদনাক্রান্ত হৃদয়ে ছন্দক ফিরে চললেন কপিলাবস্তুর দিকে। অন্যদিকে গৃহত্যাগী কুমার সিদ্ধার্থ গৌতম হেঁটে চললেন অনোমার তীর ধরে, বনের দিকে। কুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের এই মহা অভিপ্রায়ের অভিযাত্রাকে বলা হয় 'মহা অভিনিষ্ক্রমণ'।

 

বুদ্ধত্ব লাভ

 

দুঃখ মুক্তির পথ অন্বেষণে গৃহত্যাগী হলেন রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম। নদী পেরিয়ে বন ও পাহাড়। গৌতম মুক্ত মনে চলতে লাগলেন। জীবনের দুঃখ জয়ের অনুসন্ধানী লক্ষ্যে। নদীর তীরে ঋষিদের আশ্রম। কিন্তু তিনি মহান ব্রত নিয়ে চললেন শীর্ষস্থানীয় কোনো ঋষির সান্নিধ্য লাভের আশায়, যাঁকে তিনি সাধনপথের গুরু হিসেবে গ্রহণ করবেন। সাত দিন সাত রাত কাটিয়ে তিনি পৌঁছালেন বৈশালী নগরে। সেখানে স্বনামধন্য ঋষি আলাঢ় কালামের আশ্রম। তাঁর কাছে শিক্ষা অনুশীলন করলেন দর্শন, সমাধির সাত স্তর। সেখান থেকে রামপুত্র রুদ্রকের কাছে গিয়ে সমাধির আরেকটি স্তর শিখলেন। সেখান থেকে রাজগৃহের আরেক সাধকের কাছে গেলেন। সে সময় রাজগৃহের রাজা বিম্বিসারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রাজা বিম্বিসার কুমার সিদ্ধার্থ গৌতমের দিব্যকান্তি দেখে মুগ্ধ হন। রাজা বিম্বিসার তাঁকে সম্পত্তি ও রাজ্যের উঁচুপদ দিতে চাইলেন। কিন্তু যিনি নিজ রাজ্য ছেড়ে এসেছেন, তাঁর আবার লোভ কিসের? রাজগৃহ থেকে গেলেন উরুবেলায়। জায়গাটি তাঁর পছন্দ হলো। দুঃখের শেষ কোথায় জানার জন্য শান্তির পথ খোঁজার মানসে তিনি সেনানী গ্রামে পৌঁছালেন। সেখানে একটি সুন্দর বন দেখতে পেলেন। তার পাশে একটি নদী, নাম নৈরঞ্জনা। এলাকাটিও ছিল নীরব ও নির্জন। গভীর ধ্যানের জন্য উপযুক্ত মনে হলো।

 

 

 

আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে কঠিন ব্রতে মনোনিবেশ করলেন সিদ্ধার্থ। ইতোমধ্যে তিনি দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনা করলেন। শরীর জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেল। হাঁটতে গেলে পড়ে যান, বসলে উঠতে পারেন না। তবুও দুঃখের শেষ কোথায় জানা হলো না। তখন তিনি বুঝলেন, কঠোর তপস্যায় জীবন বিপন্ন হয়। তাই তিনি অল্প অল্প আহার করে 'মধ্যপন্থা' অবলম্বন করলেন। একেবারে কঠোর সাধনা নয়, আবার বিলাসী জীবনও নয়। শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবহমান রাখা ও মানসসিদ্ধিতে সচেতন থাকা আবশ্যক মনে করলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন, হয় ধ্যানে সিদ্ধিলাভ অথবা মৃত্যু। এর অন্যথা নয়। এরকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ধ্যান অনুশীলনের এক সকালে সেখানে বনদেবতার পূজা দিতে আসে এক শ্রেষ্ঠীকন্যা, নাম সুজাতা। সুজাতা ধ্যানস্থ সন্ন্যাসীকে গভীর শ্রদ্ধায় পায়সান্ন দান করলেন। সুজাতার দেওয়া দান তিনি গ্রহণ করলেন। তারপর আবার ধ্যানস্থ হলেন এক অশ্বথ বৃক্ষমূলে বসে। সেদিন ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।

 

সে ধ্যানেই রাতের প্রথম প্রহরে তিনি জাতিস্মর জ্ঞান বা পূর্বজন্মের বিষয়ে জ্ঞান লাভ করলেন। রাতের দ্বিতীয় প্রহরে তিনি দিব্যচক্ষু সম্পন্ন হলেন। তৃতীয় প্রহরে বুঝতে পারলেন জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর উৎপত্তি বিষয় । এ সময় 'চার আর্যসত্য' সম্পর্কে যথার্থ উপলব্ধি করলেন। দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ এবং দুঃখ নিরোধের পথ তিনি খুঁজে পেলেন। এরই নাম চার আর্যসত্য। এই অপূর্ব জ্ঞানময় অর্জনকে বলা হয় 'সম্যক সম্বোধি বা বুদ্ধত্ব'। এ সময় তিনি জগতে খ্যাত হলেন 'বুদ্ধ' নামে। সেই থেকে তিনি গৌতম বুদ্ধ নামে পরিচিত। তারপর তিনি জগতের মানুষের কল্যাণে তাঁর অর্জিত জ্ঞান প্রচার করবেন- এ প্রতিজ্ঞা করলেন। এ সময় তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। যে অশ্বথগাছের নিচে বসে তিনি জ্ঞান লাভ করলেন, তার নাম হলো 'বোধিবৃক্ষ'। যে স্থানে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করলেন সেই স্থানের নাম ছিল গয়া। পরবর্তীকালে বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভের ইতিহাসকে স্মরণীয় - করে রাখার জন্য এই গয়া অঞ্চলটি 'বুদ্ধগয়া' নামে খ্যাত হয়। এটি বর্তমান ভারতের বিহার প্রদেশে অন্তর্গত।

 

 

Content added || updated By
Promotion